প্রধান টার্গেট নারী-শিশু

মানব পাচারকারীরা সক্রিয় রোহিঙ্গা শিবিরে

জাহিদুর রহমান, সমকাল •  

রাত ১২টা ছুঁইছুঁই। টেকনাফের লেদা রোহিঙ্গা ক্যাম্পের পাশের মূল সড়কে অন্ধকার জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে একটি কালো গ্লাসের মাইক্রোবাস। মোটরসাইকেলের আলো দেখেই সেটি ছুটতে থাকে তীব্র গতিতে। স্থানীয় এক সাংবাদিক জানালেন, রাত গভীর হলেই টেকনাফ-উখিয়া সড়কে এমন সন্দেহজনক গাড়ির আনাগোনা বেড়ে যায়। সন্ধ্যার পরপরই রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এনজিও এবং প্রশাসনের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। সেখানে তখন সক্রিয় হয়ে ওঠে অপরাধী চক্র। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ এড়িয়ে এসব গাড়িতে চলে নারী ও শিশু পাচার।

অনুসন্ধান বলছে, কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে শ্যেনদৃষ্টি পড়েছে মানব পাচারকারীদের। নারী ও শিশুরাই প্রধান টার্গেট তাদের। রোহিঙ্গা শিবির থেকে পাচার হওয়া মেয়েদের অধিকাংশই শেষ পর্যন্ত পরিণত হয় যৌনকর্মীতে। ছেলেশিশুদের বাধ্য করা হয় বিভিন্ন শ্রমে। তাদের বেশির ভাগই পাচার হয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশেরই বিভিন্ন অঞ্চলে; পাশাপাশি ভারত ও নেপালে। গত ১৯ অক্টোবর টেকনাফ উপকূল দিয়ে সাগরপথে অবৈধভাবে মালয়েশিয়া যাওয়ার চেষ্টাকালে ছয় রোহিঙ্গা নারী-পুরুষকে উদ্ধার করে কমিউনিটি পুলিশ সদস্যরা। এরআগে ১৪ সেপ্টেম্বর টেকনাফে মালয়েশিয়া যাওয়ার পথে ১০ নারীসহ ১৬ রোহিঙ্গাকে আটক করে কোস্টগার্ড। একই দেশে যাওয়ার প্রস্তুতির সময় গত ৯ অক্টোবরও

আটক করা হয় ১১ রোহিঙ্গাকে। জুলাই মাসে ‘আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসে’র (এআরএসপিএইচআর) পক্ষ থেকে অন্তত ৪০০ জন নিখোঁজের তথ্য জানানো হয়।

কক্সবাজারে যৌনকর্মীদের নিয়ে কাজ করা স্থানীয় এনজিও ‘নোঙরে’র নির্বাহী পরিচালক দিদারুল আলম রাশেদ বলেন, ‘দারিদ্র্যের সুযোগে স্থানীয় দালাল চক্র ছাড়াও আগেই বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গাদের অনেকে নারীদের নানা উপায়ে যৌন ব্যবসায় বাধ্য করছে।’ এখন পর্যন্ত ঠিক কতজন রোহিঙ্গা নারী যৌন ব্যবসায় জড়িয়েছেন, তার সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও এই সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে বলে জানান তিনি।

ক্যাম্পের ভেতর ধর্ষণের ঘটনাও ঘটছে। চলতি মাসেই টেকনাফের লেদা ও নয়াপাড়া ক্যাম্পে দুই রোহিঙ্গা নারীকে ধর্ষণের অভিযোগে থানায় মামলা হয়েছে। কক্সবাজারে আন্তর্জাতিক দাতব্য প্রতিষ্ঠান মেডিসিন সানফ্রন্টিয়ার্সের (এমএসএফ) মেডিকেল ক্যাম্পে প্রতিদিন পাঁচ থেকে দশজন যৌন হয়রানির শিকার হয়ে চিকিৎসা নিতে আসেন বলে জানা গেছে।

ধর্ষণের ঘটনা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রতি মাসে অন্তত পাঁচ থেকে ছয়জন এইচআইভি পজিটিভধারী রোহিঙ্গা পাওয়া যাচ্ছে। কক্সবাজারের সিভিল সার্জন ডা. এম এ মতিন জানান, কতজন এইচআইভি পজিটিভ রয়েছেন, এ নিয়ে সঠিক পরিসংখ্যান নেই। তবে বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে, আড়াই হাজারের মতো রোহিঙ্গা এইডসে আক্রান্ত।

বাড়ছে শিশুদের সংখ্যা ও ঝুঁকি : টেকনাফ ও উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে শিশুদের উপস্থিতিই বেশি। জীর্ণশীর্ণ শরীর নিয়ে দল বেঁধে ঘুরে বেড়ায় তারা। জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান বলছে, রোহিঙ্গাদের ৫৫ ভাগই শিশু। সেভ দ্য চিলড্রেন জানায়, সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও প্রতিদিন প্রায় ১৩০টি শিশুর জন্ম হচ্ছে। এ হারে প্রতি মাসে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নতুন মুখ যোগ হচ্ছে প্রায় চার হাজার। রোহিঙ্গা নারী-পুরুষদের মোটেও আগ্রহ নেই জন্মনিয়ন্ত্রণ বা পরিবার পরিকল্পনায়। শিবিরগুলোতে জনসংখ্যা যে হারে বাড়ছে, তা নিয়ে বিভিন্ন মহল থেকে উদ্বেগ প্রকাশ করা হচ্ছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রত্যাবাসন দীর্ঘ হলে শিশুদের নিয়ে বিপাকে পড়তে হবে। ইউনিসেফ বলছে, শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত শিশুরা অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

সম্প্রতি কক্সবাজারে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এক রোহিঙ্গা ছাত্রীর পড়াশোনার খবর প্রকাশের পর কর্তৃপক্ষ বহিস্কার করে তাকে। সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গারা ক্যাম্পের বাইরে কোনো স্কুল-কলেজে পড়তে পারেন না। বাইরের প্রতিষ্ঠানে রোহিঙ্গাদের ভর্তির অনুমতি নেই।

ক্যাম্পের ভেতরে স্কুলগুলোতে রোহিঙ্গাদের ভাষা এবং ইংরেজিতে পড়াশোনা করানো হয়। বাংলাদেশের কারিকুলামে কিংবা বাংলা ভাষায় পড়াশোনা করানো নিষেধ বলে জানান সেভ দ্য চিলড্রেনের শিক্ষা খাতের কর্মকর্তা মোর্তুজা আহমেদ। তিনি বলেন, ক্যাম্পের স্কুলের পড়াশোনা শেষে একটি সার্টিফিকেট পেলেও ক্যাম্পের বাইরে সেটির কোনো মূল্য নেই। এর দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব স্থানীয় সমাজের ওপরেও পড়তে পারে বলে মনে করেন তিনি।